IQNA

নবী-নাতনী হযরত যাইনাবের শাহাদাত-বার্ষিকী

17:39 - March 22, 2019
সংবাদ: 2608178
১৫ রজব নবী-নাতনী হযরত যাইনাবের শাহাদাত-বার্ষিকী। এই দিনে সবাইকে জানাচ্ছি গভীর শোক ও সমবেদনা এবং এই মহামানবীর শানে পেশ করছি অসংখ্য সালাম ও দরুদ।

বার্তা সংস্থা ইকনা: মহীয়সী নারী যাইনাব  সম্মান-মর্যাদা আর অতুলনীয় সাহসী ভূমিকার কারণে ইসলামের ইতিহাসে স্বর্ণোজ্জ্বল হয়ে আছেন। কুফায় ইবনে জিয়াদের দরবারসহ নানা স্থানে এবং দামেস্কে ইয়াজিদের দরবারে বন্দী অবস্থায় ইমাম হুসাইন (আ.)’র বোন হযরত যাইনাব যেসব সাহসী বক্তব্য রেখেছিলেন তা ইতিহাসে অমর হয়ে আছে।
কোনো কোনো বর্ণনায় বলা হয় ভাই ইমাম হুসাইন (আ)'র কর্তিত মাথা-মুবারক দেখে শোক-প্রকাশের সময় নবী-বংশের এক শত্রু র আঘাতে মারাত্মকভাবে আহত হয়ে তিনি শাহাদত বরণ করেছিলেন। হযরত যাইনাব  ষষ্ঠ হিজরির ৫ই জমাদিউল আউয়াল জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন হযরত আলী  ও  ফাতেমার এর তৃতীয় সন্তান। তাঁর জন্মের সংবাদে খুশি হয়ে মহানবী (সা) বলেছিলেন: "আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেছেন, এই কন্যার নাম রাখো যাইনাব অর্থাৎ বাবার অলংকার। তিনি যাইনাবকে কোলে নিয়ে চুমু খেয়ে বললেন-সবার উদ্দেশ্যে বলছি, এই মেয়েটিকে সম্মান করবে, কেননা সে-ও খাদিজার মতো। " হযরত যাইনাব নানী হযরত খাদিজার মতোই ইসলামের দুর্গম পথে অনেক কষ্ট সহ্য করেছেন এবং দ্বীনের সত্যতাকে তুলে ধরার জন্যে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন। 

হযরত যাইনাব সালামুল্লাহ  রাসূলে খোদা (সা.), আলী (আ.) এবং ফাতিমা সালামুল্লাহি আলাইহার এর মতো মহান ব্যক্তিবর্গের সান্নিধ্য পেয়েছেন। তাই  হযরত যাইনাব সেই শিশুকাল থেকেই ছিলেন অত্যন্ত বুদ্ধিমতী এবং আধ্যাত্মিক ঐশ্বর্যে সমৃদ্ধ। শৈশবে মা ফাতেমার গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ শুনে সেই ভাষণ তাঁর মুখস্থ হয়ে যায় এবং পরে ঐ ভাষণের বর্ণনাকারী হয়ে যান তিনি। তাঁর এই সচেতনতা আর প্রখর স্মৃতিশক্তির জন্যে তাঁকে সবাই 'আকিলা' তথা বুদ্ধিমতী ও চিন্তাশীল বলতেন। 
হযরত যাইনাব শৈশবে প্রিয় নানা হযরত মুহাম্মাদ (সা.)কে হারান। তার অল্প পরেই হারান মা ফাতিমাকে। এরপর পিতা হযরত আলীর সান্নিধ্যে থেকে প্রখর জ্ঞান-গরিমা, আধ্যাত্মিকতা, নীতি-নৈতিকতা আর সচেতন প্রজ্ঞার ঐশ্বর্যে সমৃদ্ধ হয়ে তিনি বেড়ে ওঠেন। তাঁর জ্ঞান ও আধ্যাত্মিকতার কথা সবার কানে পৌঁছে যায়। নবী-নাতনী হযরত যাইনাবের প্রশিক্ষণ ক্লাসে ও কুরআন তাফসিরের ক্লাসে যোগ দেয়ার জন্যে নারীরা উদগ্রীব থাকত। 

হযরত যাইনাবের বিয়ে হয়েছিল চাচাতো ভাই আরবের বিখ্যাত ধনী আব্দুল্লাহ ইবনে জাফর তাইয়ারের সাথে। কিন্তু উন্নত চিন্তাদর্শের অধিকারী যাইনাব কখনও বস্তুতান্ত্রিক জীবন-বৃত্তে নিজেকে আবদ্ধ করেননি। তাই বিয়ের সময় যাইনাব শর্ত দিয়েছিলেন যে তিনি সারাজীবন তাঁর ভাই ইমাম হুসাইন (আ.) এর পাশে থাকবেন। আব্দুল্লাহও এই শর্ত মেনে নিয়েছিলেন। 
হযরত যাইনাবের ব্যক্তিত্বকে ভালোভাবে চেনা যায় আশুরার ঐতিহাসিক ঘটনাগুলোর মধ্যে এবং বিশেষ করে নবীজীর আহলে বাইতের সদস্যদের বন্দী হবার ঘটনায়। হযরত যাইনাবের ভূমিকা ছাড়া কারবালার বিপ্লব পূর্ণতা পেত না ও এর প্রকৃত ইতিহাসও প্রকাশ হত না। আল্লাহর ইবাদতে ও তার পথে আত্মত্যাগের মহানন্দে দুনিয়ার কোনো দুঃখ-কষ্টই তাঁর কাছে কষ্ট মনে হয়নি।

হযরত যাইনাব  তাঁর ভাই ইমাম হুসাইন (আ.) এবং তাঁর প্রিয়জনদের শাহাদাতের পর কঠিনতম সেই দিনগুলোতে অত্যন্ত ধৈর্য নিয়ে বীরত্বের সাথে সুস্পষ্ট ও উপযুক্ত বক্তব্য রেখে ইসলামের শত্রুদের নাজেহাল করেন। তিনি ইয়াজিদকে বলেছিলেন, “নানা মুসিবত ও চাপের মুখে তোমার সাথে কথা বলতে বাধ্য হয়েছি, কারণ, তোমার এমন যোগ্যতা নেই যে আমরা তোমার সাথে কথা বলব। এই পৃথিবীর জীবন ক্ষণস্থায়ী এবং তোমার সম্পদ ও বিলাসী জীবন এতেই সীমিত। আমাদের মুসিবত এই পার্থিব জগতেই শেষ হবে, কিন্তু আমরাই বিজয়ী, কারণ, সত্য আমাদের পক্ষে।” 

পিপাসায় কাতর হওয়া সত্ত্বেও হযরত যাইনাব কারবালায় নিজের অংশের পানিটুকু দান করেছিলেন শিশুদেরকে। তিনি কারবালায় কখনও কখনও গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রেখেছেন শত্রুদের সুপথের দিকে আকৃষ্ট করতে। আবার কখনও সেই কঠিন সংকটের শিকার মুমিনদের সান্ত্বনা দিয়েছেন। কখনও ব্যস্ত থেকেছেন নবীর পবিত্র বংশের তৎকালীন শেষ বাতি ইমাম হুসাইন (আ.)'র পুত্র ইমাম যাইনুল আবেদিনের জীবন রক্ষার কাজে। ধৈর্যের অনন্য আদর্শ হযরত যাইনাবকে সহ্য করতে হয়েছে প্রিয় নানাজি, বাবা ও মাকে হারানোর বেদনা ছাড়াও ভাই ইমাম হাসান এবং হজরত ইমাম হুসাইনকে হারানোর অন্তহীন দুঃখ। উল্লেখ্য, আশুরার দিন ইয়াজিদ-বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নিয়ে শাহাদত বরণ করেছিলেন হযরত যাইনাবের দুই কিশোর সন্তান আওন ও মুহাম্মাদ।


কারবালা বিপ্লবের আশুরা-পরবর্তী অধ্যায় পরিচালনা করেছেন হযরত যাইনাব। তিনি জানতেন কোথায় শান্তভাবে এবং কোথায় জ্বালাময়ী বক্তব্য রাখতে হবে। ইবনে জিয়াদ যখন পরিহাস করে প্রশ্ন করে, তোমার ভাই হুসাইনের ব্যাপারে আল্লাহর আচরণকে কেমন দেখলে?  হযরত যাইনাব খোদাপ্রেমে পরিপূর্ণ হৃদয়ে বলেছিলেন, "আমি সৌন্দর্য ছাড়া আর কিছুই দেখিনি, আল্লাহ চেয়েছিলেন যে তাঁরা শহীদ হবেন, তাঁরা তাঁদের চির-বিশ্রামস্থলে ছুটে গেছেন, আল্লাহ শিগগিরই তোমাকে ও তাঁদেরকে পুনরুত্থিত করবেন, সেদিন তুমি দেখবে যে কে প্রকৃত বিজয়ী হয়েছে।"
আমাদের উচিত হযরত যাইনাবের জীবন থেকে  ধর্মের জন্য সর্বোচ্চ কুরবানির শিক্ষা নেয়া।  

কারবালা-মহররম ত্যাগ-কোরবানির নগরে হুসাইন মহা-সূর্য
নবী-নাতনী যাইনাব বাজাল তার মহা-তুর্য 
দুঃখের সাহারায় বইলে তুমি বিজয় কেতন দ্বীনের
তোমার তেজস্বিতায় পরাভূত শিমার-জিয়াদ
যত ইয়াজিদি-কুফরি দাপট! খুলে পড়ে মুখোশ মোনাফেকের!
জাগল আবারও সূর্য ইসলামের।
হে ফাতিমা-তনয়া! দিলে নানার ধর্মে অপূর্ব ঋণ 
জাগল নয়া নক্ষত্র! ভাতিজা তোমার ইমাম যাইনুল আবেদিন।
সব দুঃখ-বেদনার কাবা-ঘর তুমি এ পৃথিবীর
স্বর্গীয় স্নেহ ও ভালবাসায় মূর্ত হে মহামানবী এ ধরিত্রীর! 
বেদনা সইলে বাবা-মা, ভাই, ভাতিজা ও পুত্র হারানোর
খোদার রাহে ত্যাজিলে বিলাস লোভের মায়াডোর! 
দেখালে ভোগে নয় ত্যাগেই অসীম সৌন্দর্য মুক্তির পারাবার। 
ধৈর্য হয়েছে মহিমান্বিত স্পর্শ পেয়ে তোমার
চির-স্মরণীয় বাগ্মিতা তোমার, তুমি বাবা আলীর জ্ঞানের অলংকার!

পার্সটুডে

 

 

captcha