IQNA

ঐতিহাসিক পলাশী দিবস

16:04 - June 24, 2022
সংবাদ: 3472037
তেহরান (ইকনা): পলাশী দিবস ( ২৩ জুন ) বাংলাদেশ তথা ভারতবর্ষের জন্য এক বেদনাদায়ক অধ্যায়ের সূচনা। বাংলার স্বাধীনতা অস্তমিত হয় সেদিন ( ২৩ জুন ১৭৫৭ সাল ) এবং শুরু হয় ব্রিটিশ বেনিয়াদের ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণের এক বেদনাদায়ক কালো যুগ যা ১৯০ বছর ( ১৭৫৭ সাল থেকে ১৯৪৭ সাল ) স্থায়ী হয়।

এই ১৯০ বছরের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণের বদৌলতে ১৭৫৭ সালের বিশ্বের এক অন্যতম শ্রেষ্ঠ ধনী দেশ বাংলা পরিণত হয় বিশ্বের অন্যতম হতদরিদ্র দেশে । বাংলায় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে মধ্যযুগের শেষে সপ্তদশ শতকে বাংলার ঐশ্বর্য পৃথিবীতে প্রবাদ বাক্যে পরিণত হয়েছিল। বিদেশী পর্যটক মানুষী ( Mannucci ) এ দেশের অবস্থা প্রত্যক্ষ করে লিখেছেন: " মুঘল সাম্রাজ্যের মধ্যে বাংলাদেশের নামই ফরাসীদের নিকট বেশি পরিচিত । এই দেশ হইতে যে অপরিমিত ধন সম্পদের দ্রব্য ইউরোপে চালান যায় তাহাই ইহার উর্বরতার প্রমাণ । মিশর দেশ অপেক্ষা ইহা কোন অংশে নিকৃষ্ট নহে বরং রেশম , সুতা , চিনি ও নীল প্রভৃতির উৎপাদনে মিশরকেও ছাড়াইয়া যায় ( Dutt . R . P. India Today . পৃ : ২২)। " সমসাময়িক ট্যাভার্নিয়ারও ( তাভার্নিয়ে মৃ : ১৬৬৬ খ্রি ) লিখেছেন : " অতি ক্ষুদ্র নগণ্য গ্রামেও ধান , গম , দুগ্ধ , তরি - তরকারি , চিনি , গুড় প্রভৃতি মিষ্টি প্রচুর পরিমাণে উৎপন্ন হয় । " অষ্টাদশ শতাব্দীতে পলাশির যুদ্ধের অব্যবহিত পরে (১৭৫৭ খ্রি) ক্লাইভ বলেন : " মুর্শিদাবাদ নগরীর বিস্তৃতি , লোকসংখ্যা ও ধন সম্পদ লন্ডন শহরের তুল্য , কিন্তু মুর্শিদাবাদে এমন বহু ধনী লোক আছেন যাঁহাদের ঐশ্বর্য লন্ডনের ধনী লোকের অপেক্ষা অনেক বেশি । " ( দ্র: রমেশচন্দ্র মজুমদার প্রণীত বাংলা দেশের ইতিহাস , আধুনিক যুগ , পৃ : ২৫৯ - ২৬০ ) । ইংরেজ কুশাসনের প্রথম উপহার হচ্ছে পলাশীর বেদনাদায়ক ঘটনার পর ১৭৭০ সালে ( বাংলা ১১৭৬ সাল ) বাংলার মহাদুর্ভিক্ষ ( যা ৭৬ এর মন্বন্তর নামে প্রসিদ্ধ ) । এ দুর্ভিক্ষ কে ব্রিটিশ বেনিয়া উপনিবেশ বাদী সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠী ( ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ) হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে বাংলার এক তৃতীয়াংশ আদিবাসীকে ( ১০ মিলিয়ন অর্থাৎ এক কোটি ) মৃত্যু মুখে ঠেলে দিয়েছিল । কিন্তু এতদসত্ত্বেও ব্রিটিশ শাসকদের রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ কমে নি।কোলকাতাস্থ কোম্পানির কাউন্সিল ১৭৭১ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি তারিখে যে রিপোর্ট দাখিল করেন তাতে বলা হয়েছে : " সম্প্রতি যে নিদারুণ দুর্ভিক্ষ হয়েছে এবং এরফলে বহুলোকের প্রাণনাশ হয়েছিল তা সত্ত্বেও বর্তমান বছরে রাজস্ব বৃদ্ধি পেয়েছে । " এক তৃতীয়াংশ লোক ধ্বংস এবং তদনুরূপ কৃষির হ্রাস হওয়ায় রাজস্বও কম হওয়ার কথা - কিন্তু তা সত্ত্বেও ১৭৭১ সালের মোট রাজস্বের পরিমাণ ১৭৬৮ সাল অপেক্ষাও যে বেশি হয়েছে হেস্টিংস বিলেতের ( ব্রিটেন ) কর্তৃপক্ষের কাছে তার কারণ ব্যাখ্যা করেছেন যে জোর জবর করে পুরাতন পরিমাণের রাজস্ব আদায় করা হয়েছে। ১৭৮৯ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সভ্য উইলিয়াম ফুলার্টন লিখেছেন : " পূর্বে  বাংলাদেশ সকল জাতির শস্য ভান্ডার এবং প্রাচ্য দেশের ব্যবসা বাণিজ্য ও সম্পদের কেন্দ্র বলে পরিগণিত হত । কিন্তু আমাদের অতিরিক্ত কুশাসনের ফলে গত বিশ বছরের মধ্যে এই দেশের অনেক স্থান প্রায় মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। অনেক স্থানে জমিতে চাষ হয় না - বিস্তৃত জঙ্গল তার স্থান অধিকার করেছে । কৃষকের ধন লুণ্ঠিত , শিল্পীরা উৎপীড়িত । পুনঃ পুনঃ দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে .... এবং এরফলে লোকসংখ্যা কমে গিয়েছে ।" ( ড: রমেশচন্দ্র মজুমদার প্রণীত বাংলাদেশের ইতিহাস , আধুনিক যুগ , পৃ : ২৬৯ ) । শুধু তাই নয়, এই ১৯০ বছরের ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদী কুশাসনের ফলে বাংলায় বিভিন্ন সময় ছোট বড় বহু দুর্ভিক্ষে অগণিত হতভাগ্য মানুষের প্রাণহানি হয়েছে । আর ১৯৪৩ সালে দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ চলাকালে জাপানের হাতে পূর্ব বাংলার পতন হওয়ার সম্ভাবনার অজুহাত দেখিয়ে পোড়ামাটির নীতি অবলম্বন করত:

এ অঞ্চলের খাদ্য সামগ্রী যাতে দখলদার জাপানী বাহিনীর হাতে না পড়ে সেজন্য ব্রিটিশ সরকারের নির্দেশে খাদ্য সামগ্রী জব্দ , ধ্বংস এবং আমদানি বন্ধ করা হলে পূর্ব বাংলায় কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় এবং দেড় থেকে আড়াই মিলিয়ন অধিবাসী কৃত্রিম এ দুর্ভিক্ষে প্রাণ হারায় । নোবেল লরিয়েট বাঙ্গালী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের মতে উক্ত দুর্ভিক্ষে ( বাংলার ) তিন মিলিয়ন লোকের প্রাণহানি হয়েছিল।

      এখানে প্রসঙ্গত : উল্লেখ্য যে , ১৭৭০ সালের মহাদুর্ভিক্ষ সহ ১৯০ বছরের ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদী শাসনামলে যে সব দুর্ভিক্ষ বাংলায় এবং বৃহত্তর ভারতবর্ষে বহু কোটি লোকের প্রাণহানি হয়েছে তা মুসলিম ও হিন্দু রাজা বাদশাহদের শাসনামলে কখনো ঘটে নি । তাই প্রকৃত পক্ষে ব্রিটিশ শাসন আসলে বঞ্চনা-গঞ্জনা , বৈষম্য , জোর-জুলুম ও অন্যায়ের শাসন বরং কুশাসন যা বাংলা তথা ভারতবর্ষ কখনো প্রত্যক্ষ করে নি এবং তা ছিল সত্যিকার অর্থে বিদেশী বহিরাগত লুটেরা নর ঘাতক চোর বাটপার ডাকাতদের শাসন । এমনকি বাংলা ও ভারত বর্ষের মুসলিম শাসকগোষ্ঠী বহিরাগত হওয়া সত্ত্বেও তাদের দীর্ঘ পাঁচ শতাব্দীর অধিককাল শাসন ও রাজত্ব বিদেশী ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদী শাসন অর্থাৎ বঞ্চনা - গঞ্জনা ও বৈষম্যের শাসন বলে বাংলা বা ভারতবাসীর কাছে গণ্য ও বিবেচিত হয় নি ।

    যা হোক বাংলায় ব্রিটিশ শাসন ছিল সত্যিকার অর্থে অত্যন্ত ধ্বংসাত্মক । প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ আর সি দত্তের মতে ব্রিটিশ শাসন ও শোষণের ফলশ্রুতিতে বাংলার শিল্প স্তব্ধ ও বন্ধ এবং এদের সম্পদ নি:শেষ হয়ে যায়। বাংলার সম্পদ লুটতরাজ করে ব্রিটিশরা ব্রিটেনে শিল্প বিপ্লব ঘটিয়েছিল । বাংলা থেকে পুঁজি এনে তা ব্রিটেনে সদ্য প্রতিষ্ঠিত কল-কারখানায় বিনিয়োগ করা হত এবং এর ফলে বাংলাদেশ অঞ্চলের শিল্পায়ন বন্ধ হয়ে যায় এবং তা অচিরেই এক অশিল্পায়িত ( শিল্পহীন ) অঞ্চলে পরিণত হয় । রমেশচন্দ্র মজুমদার এ প্রসঙ্গে লিখেছেন : " বাংলাদেশে ইংরেজের প্রভুত্ব স্থাপনের অল্প কাল পরেই ইংলন্ডে নবাবিষ্কৃত যন্ত্রপাতির বাষ্পীয়শক্তির সাহায্যে শিল্পের নবযুগ আরম্ভ হয় । অনেকের মতে কেবলমাত্র নূতন নূতন আবিষ্কার দ্বারা এই শিল্প বিপ্লব ঘটান সম্ভব হইত না । ইংরেজ বাংলাদেশ হইতে যে বিপুল অর্থ ইংলন্ডে নিয়া যায় তাহাকে মূলধন করিয়াই এই বিপ্লব সম্ভবপর হইয়াছিল ( Dutt , R . Palme , India Today, পৃ : ৯৪ ) । "

     বাংলার ঐতিহ্যবাহী বিশ্ববিখ্যাত ( অতি উন্নত মানের দামী ) অতি সুক্ষ্ম ও মসৃণ ( মিহি ) মসলিন সুতি বস্ত্র শিল্পের ধ্বংস হয় ব্রিটিশ বস্ত্র নির্মাতাদের চক্রান্তে যারা মসলিন বস্ত্র বয়নকারী তাঁতীদের হাতের আঙ্গুল কেটে দিয়েছিল এবং তাদের তাঁতগুলো গুড়িয়ে দিয়েছিল । যা হোক ব্রিটেন ভারী শুল্ক আরোপ করে এবং উত্তর ইংল্যান্ড ও স্কটল্যান্ডের নিম্নাঞ্চলে নব্য প্রতিষ্ঠিত বাষ্পচালিত মিল ও কারখানা সমূহে উৎপাদিত সস্তা মূল্যের কাপড়ের সয়লাব করলে মসলিন বস্ত্র আমদানী কার্যত: বন্ধ করে দেয়া হয় । শুধু তাই নয় এখানকার উৎপাদিত বস্ত্র সমগ্র ভারত ও ব্রিটিশ বাজার সমূহ দখল করে নেয়। ভারত তখনও তুলা উৎপাদন করছিল ; কিন্তু বাংলা আর বেশি বস্ত্র বয়ন করতে পারে নি । তাঁতীরা ভিক্ষুকে পরিণত হয় । ১৭৬০ সালে যে ঢাকার লোকসংখ্যা ছিল কয়েক লক্ষ ১৮২০ সালের মধ্যে তা এসে দাঁড়ায় ৫০০০০এ ( দেখুন : ২০১৪ , ২০ জুন ব্রিটেনের গার্ডিয়ান পত্রিকায় প্রকাশিত Ian Jack প্রণীত প্রবন্ধ : Britain took more out of India than it put in - could China do the same to Britain ? অর্থাৎ ব্রিটেন ভারতে যতটুকু রেখেছে ( ঢেলেছে বা দিয়েছে ) তার চেয়ে ঢের বেশি ভারত থেকে বের করে নিয়ে গেছে - তাহলে চীনও কি ব্রিটেনের সাথে এই একই আচরণ করতে পারে ? । এই প্রবন্ধে লেখক আরো লিখেছেন : ভারতের অর্থনীতির বৃহদাংশ ১৮০০ অর্থাৎ ঊনবিংশ শতকেই ব্রিটিশ প্রযুক্তির ( ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ )  হাতে ধ্বংস হয় । তিনি আরো লিখেছেন : " পরবর্তীতে ( ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদী শাসন ও শোষণের বদৌলতে ) ভারত শিল্পোৎপাদিত পণ্য রফতানির বদলে পরিণত হয় কাঁচা মাল , খাদ্য সামগ্রী, তুলা , পাট , কয়লা , আফিম , চাল , মসল্লা এবং চা রপ্তানিকারক দেশে । "

       শুধু তাই নয় বাংলা নদীমাতৃক কৃষিপ্রধান দেশ। পানি এবং নদ-নদী , খাল-বিল , পুকুর , হাওর , জলাশয় প্রভৃতি বাংলার জনজীবন ও অর্থনীতির ক্ষেত্রে অপরিসীম গুরুত্বের অধিকারী। এক কথায় বাংলার মতো দেশগুলোর ক্ষেত্রে পানি সম্পদের সুব্যবস্থাপনা চৌকষ ও দক্ষ শাসন ও ব্যবস্থাপনারই সাক্ষর ও নিদর্শন স্বরূপ। মধ্যযুগে ( ১২০০- ১৭৫৭ ) মুসলিম শাসক ও প্রশাসকদের তত্ত্বাবধানে প্রাচীন ওভারফ্লোসেচ ব্যবস্থা ( Overflow Irrigation System) উন্নত ও সংস্কার করে ট্যাংক সেচ ব্যবস্থায় ( Tank Irrigation System) রূপান্তরিত করা হয়। এ সময় নদ-নদীর তীর বাঁধাই ও বেড়ি বাঁধ নির্মাণ করে বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও পানি নিষ্কাশনের সুযোগ-সুবিধা সমূহের ( Drainage facilities) উন্নয়ন শুরু হয় এবং তা ১৭৫৭ সালে মুসলিম ( মুঘল - নবাবী ) শাসনের শেষ পর্যন্ত চলতে থাকে । উত্তম সেচ , পানি নিষ্কাশন এবং নৌচলাচল নিশ্চিত করার জন্য মুঘল শাসকরা পূর্ববর্তী সেচ ব্যবস্থা সমূহকে বহাল রেখে দীর্ঘ নদী পথ জুড়ে ( অর্থাৎ নদীর পাশাপাশি এবং নিকটে ) বাড়তি খাল খনন এবং নদীতীর বাঁধাই ও বেড়ি বাঁধ নির্মাণের ( বাঁধ দিয়ে পরিবেষ্টন বা সংরক্ষণ ) ধারণা প্রবর্তন করেন। মুঘলরা নদ-নদী ড্রেজিং করার বিষয়টিও সংযোজন ( প্রবর্তন ) করেন ( Ali , 2002 ) ।

        বাংলার প্রাদেশিক মুঘল প্রশাসন নদীতীর বাঁধাই , বেড়িবাঁধ , সড়ক , রাস্তা-ঘাট , পুল এবং নদ-নদী ড্রেজিং , তত্ত্বাবধান ও দেখভাল করার জন্য পুলবন্দী দফতর ( Pulbandi Daftar/دَفْتَرِ  پُلْبَنْدِی ) নামে স্বতন্ত্র একটি প্রশাসনিক অফিস ও বিভাগ পরিচালনা করতেন । কিন্তু ১৭৫৭ সালে বাংলায় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের আধিপত্য ও শাসন প্রতিষ্ঠিত হলে নয়া প্রশাসন অর্থাৎ ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ এই পুলবন্দী দফতর বিলুপ্ত করে দেয় যা বাংলার জন্য ভয়াবহ বিপর্যয় বয়ে এনেছিল। তখন থেকে অর্থাৎ ১৭৫৭ সাল থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ১৯০ বছর জনস্বার্থ বিরোধী ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী ঔপনিবেশবাদী সরকার কর্তৃক বাংলার পানি সম্পদ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ উপেক্ষিত হয় এবং সরকারের পানি ব্যবস্থাপনা ও নীতি না থাকার কারণে বাংলায় মুহুর্মুহু বন্যা ও শস্যহানি হতে থাকে ।  ( বিস্তারিত জানার জন্য পড়ুন : AHM Kausher প্রণীত Water Resources Management in Bangladesh : Past , Present & Future - এ প্রবন্ধটি , Email: engineerkausher@yahoo.com )

     প্রসঙ্গত: উল্লেখ্য যে, ব্রিটিশ শাসনামলে সময়মত নদ-নদী সংস্কার ও ড্রেজিং এবং নদীর তীর বাঁধাই এবং বেড়িবাঁধ কার্যক্রম চালু না থাকার কারণে নদ-নদী ভরাট হয়ে বন্যা ও নদী ভাঙ্গন ইত্যাদির প্রকোপ বৃদ্ধি পায়। আজ বাংলাদেশে নদ-নদী ভরাট হয়ে যাওয়া বা সেগুলো হেজেমজে যাওয়ার সমস্যা তথা ভয়াবহ বন্যা সমস্যা ইত্যাদি হচ্ছে প্রকৃতপক্ষে দুষ্টু সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ কুশাসন ও শোষণের রেখে যাওয়া উত্তরাধিকার। **

----------- ----------------------------------

   ** [[ রমেশচন্দ্র মজুমদার বাংলা দেশের ইতিহাস গ্রন্থে ( আধুনিক যুগ , পৃ : ৫৬৭ ) লিখেছেন: " আলোচ্য যুগে ( বিংশ শতাব্দীর শুরু ১৯০৫ থেকে ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ বিভাগ পর্যন্ত ) কৃষিজাত দ্রব্যের উৎপাদন অনেক হ্রাস পাইয়া ছিল । জঙ্গল পরিষ্কার করা এবং রেল লাইন বিস্তারের ফলে জল স্রোতের স্বাভাবিক গতিরোধ ইহার জন্য দায়ী।"

      ব্রিটিশ নদী প্রকৌশলী স্যার উইলিয়াম উইলকক্স ১৯২৮ সালে দেওয়া এক বক্তৃতায় অভিযোগ করেন : " ইংরেজ আমলের গোড়াতেই সনাতন খাল ব্যবস্থাগুলোকে কাজে লাগানো ও সংস্কার তো করাই হয় নি বরং রেলপথের জন্য তৈরি বাঁধের মাধ্যমে এগুলো ধ্বংস করা হয়েছে । "

    ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ জি থমসনও

হিন্দু - মুসলিম যুগের নদীব্যবস্থাপনা ধ্বংসকেই বাংলার কৃষি ও জলদেহ বিপর্যস্ত করার দায় দিয়েছেন । তাতে মাটি অনুর্বর হয়েছে , মাছের আধার ধ্বংস হয়েছে , নদীস্ফীতি জনিত চাপে নদীর পাড় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ( যারফলে নদী ভাঙ্গন , নদী ভরাট , জলাবদ্ধতা ইত্যাদি হরেক রকমের সমস্যারও উদ্ভব হয়েছে ব্যাপক ভাবে ) । দেশ ভরে গেছে ক্ষতিকর ও অপ্রয়োজনীয় পৌর্তিক কাজ দিয়ে । ভারতীয় নদী বিশেষজ্ঞ প্রশান্ত মহলানবীশ ১৯২৭ সালেই বলেছিলেন : " বাঁধের ফলাফল হিসেবে তলানি জমে নদীতল ধীরে ধীরে ওপরে উঠে আসবে । " ( তথাকথিত ) উন্নয়নবাদীরা শোনেন নি । (( দ্র : ফারুক ওয়াসিফ প্রণীত পানি নামার পথে উন্নয়নের যত বাধা , প্রথম আলো ))

 

তাহলে স্পষ্ট হয়ে যায় অপরিকল্পিত রাস্তাঘাট ও রেল লাইন নির্মাণ, পানি সম্পদ অব্যবস্থাপনা ,নদ - নদী সংস্কার ও ড্রেজিং না করার কারণে নদী ভরাট হয়ে বন্যা সমস্যা , নদী ভাঙ্গন , শস্যহানি , জলাবদ্ধতা ইত্যাদি দুষ্টু ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের রেখে যাওয়া উত্তরাধিকার যা থেকে এত পাশ্চাত্য শিক্ষিত প্রকৌশলী ও আধুনিক যন্ত্রপাতি থাকা সত্ত্বেও আজও আমরা রেহাই পাচ্ছি না !!!! এর কারণ কী ? মুঘল প্রকৌশলী ও পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনার কর্মকর্তারা ছিলেন একাধারে যেমন নিজেদের কর্ম ও পেশায় দক্ষ ঠিক তেমনি বাংলার  ভৌগলিক পরিবেশ প্রকৃতি সম্বন্ধে ছিল তাদের সম্যক জ্ঞান ও পরিচিতি এবং নিষ্ঠা যা ব্রিটিশদের ছিল না এবং পরবর্তীতে পাশ্চাত্য শিক্ষিত দেশীয় প্রকৌশলী ও পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনার কর্মকর্তাদের মধ্যেও যার তীব্র অভাব  পরিলক্ষিত হচ্ছে । বাংলাদেশে বন্যা আসলে ব্রিটিশ আমল থেকে অপরিকল্পিত সড়ক , রাস্তাঘাট ও রেল লাইন নির্মাণ এবং নদীনালা , খালবিল , জলাশয় ও জলাভূমি সংস্কার না করার অমোঘ পরিণতি স্বরূপ। আর এর জলজ্যান্ত প্রমাণ হাওর অঞ্চলের সাম্প্রতিক বন্যাও অত্র অঞ্চলে রাস্তা নির্মাণের ভুল কার্যক্রমের মাশুল স্বরূপ যা পানির স্বাভাবিক গতি ও প্রবাহে বিঘ্ন সৃষ্টিকারী এবং সর্বনাশা বন্যা ও জলাবদ্ধতার জন্য দায়ী । ]] **

-------------------------------------------------

     ব্রিটিশ শাসন ও শোষণের আরেকটি মারাত্মক কুফল হচ্ছে বাংলা তথা সমগ্র ভারত বর্ষে ঘুষ - উৎকোচ সহ দুর্নীতির অভূতপূর্ব প্রসার , সয়লাব ও দৌরাত্ম ।দেখুন : রমেশচন্দ্র মজুমদার প্রণীত বাংলাদেশের ইতিহাস, আধুনিক যুগ , পৃ: ৩৪ - এ বর্ণিত হয়েছে : " পুলিশ , রাজস্ব আদায় , শুল্ক , লবণ ও আফিং বিভাগে এবং আদালতে নিযুক্ত নিম্নপদস্থ ভারতীয় কর্মচারীগণ অত্যন্ত কম বেতন পাইত । দারোগা , লবণ বিভাগের অধ্যক্ষ , দেওয়ান , মোহরার ও পিয়ন যথাক্রমে মাসিক ৩০, ৫০ , ৫ ও আড়াই টাকা বেতন পাইত । সুতরাং সর্বত্রই ঘুষ নেওয়ার প্রথা খুব ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল। " এই ব্রিটিশ শাসনামলে উদ্ভব হয় মিথ্যা মামলা বাজ , পেশাদার , সাক্ষী , উপজীবী ( পরজীবী বলেই ভালো ) , উকিল , মোক্তার , টাউট , ঘৃণ্য গোয়েন্দা ও ঘুষখোর কোর্ট - আমলা । ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শোষণ নীতির সাথে সামঞ্জস্য শীল করে গ্রামে গঞ্জে গড়ে তোলা হয় বিপুল কলেবরে এক মধ্যবিত্ত শ্রেণী । অর্থনীতি ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ উৎপাদনের সাথে এদের কোন সম্পর্ক ছিল না । পর নির্ভর স্বার্থপর অর্থপিশাচ বেতনভুক এই গ্রাম্য মধ্যবিত্ত শ্রেণীর হাজার নখদন্ত বাংলার কৃষকদের দিকে ধাবিত হয়। সংবাদ প্রভাকর লিখেছে : পত্তনিয়াদার  তালুকদার দরপত্তনিয়াদার ইত্যাদিও ভূমির উৎপন্ন ভোগীর সংখ্যা রাজ নিয়ম বলে যত বৃদ্ধি হইয়া আসিয়াছে

ততই কৃষকের ক্লেশ বৃদ্ধি হইয়াছে .... ( ৫ ভাদ্র , ১২৬৪ ) । কৃষকদের শ্রমোৎপন্নভোগীদের সংখ্যা গ্রামে গঞ্জে বেড়েছে , ব্রিটিশ শাসকরা আইনবলে তাদের সংখ্যা ও শক্তি বৃদ্ধি করেছেন । উৎপাদন কর্ম্ম থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন এ রকম শোষণমুখী অর্থলোভী বিপুলাকার মধ্যশ্রেণী বাংলার গ্রাম্য সমাজে ব্রিটিশ পূর্ব যুগে , মুসলমান বা হিন্দু রাজত্বকালে ছিল না ...... ( বিনয় , ৫ । ৩০ পৃ : ) [ দ্র: রমেশচন্দ্র মজুমদার প্রণীত বাংলাদেশের ইতিহাস , আধুনিক যুগ, পৃ: ২৭৬ ] ।

     ব্রিটিশ শাসকরা দেশের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটায়।

অভিজ্ঞতায় দেখা যায় যে , আইন- শৃঙ্খলা রক্ষায় কর্ণওয়ালিস কোড সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়। বরং চুরি , ডাকাতি , রাহাজানি , হত্যা ও দাঙ্গার হার আগের ( মুঘল ও নবাবী আমল ) চাইতে অনেক বেড়ে যায়। জনজীবন আগের ( মুঘল ও নবাবী আমলের ) চাইতে অনেক বেশি অনিরাপদ হয়ে যায় ( দ্র: ড: আবদুর রহীম এবং অন্যান্য প্রণীত বাংলাদেশের ইতিহাস , পৃ : ৫০ )। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকচক্র চিরস্থায়ী ভূমি বন্দোবস্তের মাধ্যমে মুঘল শাসনতন্ত্রের রায়তদের যে প্রথাভিত্তিক অধিকার ছিল সে অধিকার বিলুপ্ত করে দেয় (( অর্থাৎ এ দেশের রায়ত শ্রেণী সরকারের রায়ত বা প্রজা নয় বরং ইউরোপীয় সামন্ততন্ত্রে যেমন রায়ত বা সাধারণ অধিবাসীরা ভূমিহীন বা ভূমির মালিক বিহীন প্রজা বা ভূমিদাস ছিল ঠিক তেমনি এ দেশের রায়ত শ্রেণীকেও ভূমিহীন বা ভূমির মালিক বিহীন প্রজা বা ভূমিদাসে পরিণত করা হয় । )) বাংলার রায়তশ্রেণী জমিদারের ইচ্ছাধীন প্রজায় পরিণত হয় । কৃষক হয়ে যায় জমিদারের প্রজা , সরকারের রায়ত নয় । (( মুঘল ও নবাবী যুগে জমিদার শ্রেণী ভূমির মালিক ছিল না । তারা ছিল তখন ট্যাক্স কালেক্টর মাত্র । এমনকি তারা জমির ট্যাক্স বা খাজনা নিজেরাও নির্ধারণ করতে পারত না । কৃষকের আর্থিক অবস্থা , উৎপাদিত ফসলের পরিমান বা ফলন এবং বন্যা ও খরার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ ইত্যাদি বিবেচনা করত: ভূমি র ট্যাক্স ও খাজনার পরিমাণ নির্ধারণ করত সরকার ও প্রশাসন। জমিদার এর খেলাপ করলে তাকে শাস্তি পেতে হত । আর রায়ত বা প্রজা কর দিতে না পারলে তাকে জমি থেকে উৎখাত ও বিতাড়নের অধিকার জমিদারের ছিল না মুঘল ও নবাবী আমলে । প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফসল হানি বা উৎপাদন কম হয়ে গেলে তখন হয় কর মওকুফ করে দেয়া হত অথবা কমিয়ে দেয়া হত । বরং বেশ কিছু ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের ঋণ ও আর্থিক সাহায্যও করা হত সরকার ও প্রশাসনের পক্ষ থেকে। তাই মূঘল ও নবাবী আমলে বাংলা বা ভারতে জমিদার বা সামন্ত শ্রেণী ইউরোপীয় জমিদার বা সামন্ত শ্রেণীর মতো ছিল না বা এটাকে ঠিক প্রকৃত জমিদারী বা সামন্ত প্রথাও বলা যাবে না বা বলা ঠিক হবে না। বরং ইউরোপীয় ধাঁচে প্রকৃত সামন্ত ও জমিদার তন্ত্র ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী ঔপনিবেশিক শাসনামলেই বাংলা তথা ভারতবর্ষে প্রবর্তিত হয় । ]] কৃষকের উদ্বৃত্ত আয় ভোগ করত উৎপাদনের সাথে সম্পর্কহীন জমিদার ও মধ্যস্বত্ব ভোগী শ্রেণী , কৃষক নয় । এ ছাড়া ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন বাংলার সমাজদেহে ( বৃহৎ পরিসরে ভারত বর্ষে ) এক মহা চারিত্রিক নৈতিক সংকটও সৃষ্টি করে । যা হোক ঘুষ , দুর্নীতি , অপরাধ , চারিত্রিক-নৈতিক অবক্ষয় , রাহাজানি , মারামারি , দাঙ্গা-হাঙ্গামা , আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, শোষণ , দারিদ্র্য , বঞ্চনা , পশ্চাদপদসরতা , সামাজিক অবক্ষয় , অপসংস্কৃতি ইত্যাদি যা আমরা প্রতিনিয়ত প্রত্যক্ষ করছি তা আসলে এই ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদী শাসনের বিষ ফল ছাড়া আর কিছুই নয় যার অশুভ সূচনা হয়েছিল ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর আম্র কাননে সেই ঐতিহাসিক মহা বিপর্যয়ের মাধ্যমে ।

     প্রাক পলাশী বাংলা আর পলাশী উত্তর বাংলার মাঝে বিস্তর ব্যবধান । তাই ঐতিহাসিক পলাশী দিবস সত্যি তাৎপর্যপূর্ণ। এই দিবসের সঠিক পর্যালোচনার আলোকে সাম্রাজ্যবাদী ঔপনিবেশিক শাসনামলে অপরাধী ব্রিটেনকে বাংলায় দুর্ভিক্ষকে বার বার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে কোটির অধিক অধিবাসীর মৃত্যু এবং এ দেশের ধনসম্পদ ও ঐশ্বর্য লুণ্ঠনের মতো জঘন্য অপরাধ সমূহের জন্য আন্তর্জাতিক আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে ক্ষতিপূরণ আদায়ের উদ্যোগ গ্রহণ সরকার , রাষ্ট্র , সুধী ও সুশীল সমাজের একান্ত কর্তব্য।

 

( এই প্রবন্ধ ২০১৮ সালে লেখা। তবে এখন এতে কিছু পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করা হয়েছে লেখকের তরফ থেকে।)

ইসলামী চিন্তাবিদ এবং গবেষক হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলেমিন মুহাম্মদ মুনীর হুসাইন খান

 

captcha